সাদা সোনা খ্যাত চিংড়িতে দেখা দিয়ে মড়ক, দিশেহারা চাষি

মাথায় এলোমেলো চুল। গতরে কাদাঁ মাখা গেঞ্জি। পরনে ভেঁজা লুঙ্গি। চিংড়ি পাড়ে বসে চেয়ে আছেন দিগন্তের শেষ সিমানায়। দৃষ্টি যতদূরে যায়। কি ভাবছেন দাদা বলতেই চমকে উঠল পরিমল বিশ্বাস। কথা বলে জানা গেল বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার কুরমনি গ্রামে তার বসবাস। বিধবা মা ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে ৫ সদস্যর পরিবার। ধারদেনা করে এ বছর ২ একর জমিতে ৫ হাজার গলদা চিংড়ির চাষ করেছিলেন। মাছের উৎপাদনও ছিল ভাল। আশায় বুক বেঁধে ছিলেন এবার মাছ বিক্রি করে সকল দেনা পরিশোধ করবেন। কিন্তু তার সে আশার গুড়েবালি।গত দু’দিনে মরে ভেসে উঠেছে ঘেরের সকল চিংড়ি মাছ। এখন পাওনাদারদের আতংকে রয়েছেন তিনি। তীব্র গরমের পর হঠাৎ বৃষ্টিতে ঘেরের পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়ায় বাগেরহট জেলার চিতলমারী, ফকিরহাট, মোল্লাহাট ও বাগেরহাট সদর উপজেলার চিংড়ি ঘের গুলোতে মড়ক দেখা দেয়ায় জেলার সর্বত্র এখন এমন চিত্র। যার ফলে সব হারিয়ে জেলার এ উপজেলা গুলোতে চিংড়ি চাষ করা চাষিরা দিশেহারা হয়ে পরেছেন। বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋন ও ধারদেনা করে চিংড়ি চাষ করা ঘের মালিকরা পাওনাদারদের আতংকে দিনপার করছেন। 

এদিকে জেলার চিংড়ি ঘের গুলোতে মড়ক দেখা দেয়ায় চলতি ২০১৯-২০ মৌসুমে রফতানিজাত চিংড়ি উৎপাদন লক্ষ্য ব্যাহত হতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেছে জেলা মৎস্য অধিদপ্তর। আর এ কারনে জেলার মড়ক আক্রান্ত উপজেলা গুলোতে চাষিদের সচেতন করতে মাইকিং করছেন তারা।
চিতলমারী উপজেলার দূর্গাপুর গ্রামের চিংড়ি চাষি প্রতুল হালদার বলেন, এ বছর আমি ১ একর জমিতে ৬ হাজার গলদা চিংড়ি চাষ করেছিলাম। হঠাৎ করে তারও সকল চিংড়ি মাছ মরে গেছে। এতে তার কমপক্ষে ২-৩ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এবার চিংড়ি চাষে প্রায় ২ লাখ টাকার দেনা হয়েছেন। এখন কিভাবে এ দেনা পরিশোধ করবেন এই চিন্তায় তিনি দিশেহারা। 
একই উপজেলার ব্রক্ষ্মগাতি গ্রামের দেবেন মন্ডল বলেন, এ বছর আমি ৭২ শতক জমিতে ২১ হাজার গলদা ও বাগদা চিংড়ির চাষ করেছিলেন। মাছের উৎপাদন খুব ভাল ছিল। তারও ঘেরের চিংড়ি মাছ মরে ভেসে উঠেছে। কয়েক লাখ টাকার ক্ষতি সাধন হওয়ায় তিনিও মূষড়ে পড়েছেন। 
শুধু পরিমল, প্রতুল আর দেবেন নয়। গত দুইদিনে চিতলমারী উপজেলার লড়ারকুল, বাবুয়ানা, উমাজুড়ি, কালিগঞ্জ, খাসেরহাট, বারাশিয়া, কালশিরা, কুরমনি, দূর্গাপুর, ব্রক্ষ্মগাতি, রায়গ্রাম, করাতেরদিয়া, খিলিগাতি, শ্রীরামপুর, ডুমুরিয়া, পারডুমুরিয়াসহ ২০ গ্রামের কয়েক শ’ চিংড়ি চাষির ঘেরের মাছ মরে ভেসে উঠেছে। ফলে দেনার দায়ে জর্জারিত এসব চিংড়ি চাষিরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। 
এ ব্যাপারে চিতলমারী উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা সোহেল মোঃ জিল্লুর রহমান রিগান জানান, অবহাওয়া জনিত কারণে চিংড়ি ঘেরে অ´িজেনের ঘাটতি দেখা দেয়ায় মাছ মারা যাচ্ছে। এতে উপজেলার শতকরা ৫-৭ ভাগ ঘেরের মাছ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এ জন্য শতকে ৫-৭ টি অক্সিজেন ট্যাবলেট দিয়ে ও সেচ মেশিন দিয়ে পানি ওলট-পালট করে এ সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। তাই চাষিদের সচেতন করতে মৎস্য অফিসের পক্ষ থেকে এলাকায় মাইকিং ও সভা করা হচ্ছে। 
এদিকে একই চিত্র জেলার ফকিরহাট উপজেলাতেও। ফকিরহাট উপজেলার ফলতিতা এলাকার চিড়িং ঘের ব্যবসায়ী আলম শেখ, সোহান শেখ ও সুমন হাওলাদারসহ বেশ কয়েকজন বলেন, গত শনিবার ফকিরহাট উপজেলায় রাতে হঠাৎ বৃষ্টিতে ঘেরের পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়ায় হাজার হাজার ঘেরের গলদা-বাগদা চিংড়ি মাছ মারা গেছে। এই মড়ক আমাদের সহায় সম্বল নিয়েছে। 
বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. খালেদ কনক বলেন, তীব্র গরমের পর হট্যৎ বৃষ্টিতে জেলার মৎস্য ঘের গুলোতে অক্সিজেনের মাত্রা করে যাওয়ার ফলে এমন সমস্য দেখা দিয়েছে। ইতি মধ্যে আক্রান্ত উপজেলা গুলোতে মাইকিং করে পুকুরে অক্সিজেন ট্যাবলেট ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। চাষিদের আতঙ্কিত না হয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করে এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। তবে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।

Post a Comment

Previous Post Next Post